স্বাধীনতা, একটি স্বাধীন দেশ ও একটি পতাকার কতটুকু মর্যাদা ও সম্মান বিদেশ থেকে অনুভব করা যায় বেশী।
এর প্রধানত: দুটি কারণ আছে বলে আমার মনে হয়। প্রথমত: দেশের জন্য মন টান, দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের প্রতি স্বভাব সুলভ বা জন্মগত সম্পর্ক যার নাম স্বদেশ প্রেম। এ প্রেমের
কারণ, সেখানে যে মা, বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-সুজন এবং ছেলেবেলার ফেলে আসা স্কুলের সহপাঠি, খেলার সাথীরা থাকেন।তাদের নিয়ে কত স্মৃতি, কত প্রীতি, তার কি কোন কিনারা আছে? না আছে শব্দে ছন্দে ব্যাখ্যা দেবার সুযোগ? না, নেই। এ মায়ার এবং মায়ের বন্ধনের নামই দেশপ্রেম, স্বাধীনতার প্রার্থনা।
দেশপ্রেম তখনই ফুলে ফলে সজ্জিত হয় যখন একটি দেশ স্বাধীন থাকে, দেশের একটি পতাকা থাকে।
অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধি থাক আর না থাক, মনে গর্ব থাকে যে, আমি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক। আমার একটি পতাকা আছে।
স্বাধীনতার ধারণা অহংকারের আরেক নাম। বিশ্বে স্বীয় শীর সমুন্নত করে তুলে ধরার সীমাহীন গরিমার সোনালী দরজা। এ অহংকার হালাল, এ অহংকার স্বর্গে যাবার প্রতিযোগিতার সূচক-অধ্যায়।
আমার একটি স্বাধীন দেশ আছে- এ দরদ মাখা বাক্যের কোন তুলনা হয় না পৃথিবীতে। পুরো দুনিয়া এক ইঞ্চি স্বাধীন-ভূমির সমান নয়। এক খন্ড অধিন দেশ গোটা বিশ্বের জন্য ক্যনসার। যেমন প্যালেস্টাইন। আজ ৬৫ বছর ধরে এই ইস্যুতে সারা বিশ্ব দু্ই ভাগে বিভক্ত। মাঝ খানে স্বদেশহারা প্যালেস্টাইনীর ঝরছে রক্ত।
কারণ, পৃথিবী একক কোন সীমানার নাম নয়। পৃথিবীর অবস্থান কিছু দেশ বা মহাদেশকে নিয়ে। সাগর বা মহা সাগরকে নিয়ে। কিংবা পাহাড়- পর্বতকে নিয়ে।
পৃথিবীর সীমানায় স্রষ্টার সম্মতি আছে। তাই যে দেশের সীমানা নেই সে দেশ ‘পৃথিবী’র জন্য কষ্টের! যে নদী ধারা হারা, তার উত্তাল তরঙ্গে বাঁধা বিপত্তি সে নদী অসুস্থ। সে নদী ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়; যা কিনা ‘পৃথিবী’র জন্য নিরানন্দের।
নদীর জল, জলের হাঁস, হাঁসের বাড়ি ঐ শ্যাওলাপনারও একটি জায়গা আছে, বিচরণ বা বয়ে যাবার মত সুযোগ আছে, এতটুকুন অধিকার বা সুযোগ অথবা স্বাধীনতা হাঁস ও শ্যাওলার না থাকলে হাঁস খাদ্যাভাবে, শ্যাওলা জল শুন্যতায় মারা যাবে।মানুষের স্বাধীনতা ঠিক একই রকম; তবে প্রায়োগিক বিচারে এর চেয়ে কিছুটা বেশী। কারণ, আমরা জানি, পশু, পাখি, শ্যাওলা ও শামুকের স্বাধীনতা সাময়িক বা অনেকটা ভাবলেশহীন। নন্দনতত্ব ও দর্শন-দেশনা সেখানে বেশী কাজ করে না। এদের বোধ-বিশ্বাস মানুষের মত তেমন প্রখর নয়। এদের চাহিদা জৈবিক ও ক্ষণিক। কিন্তু মানুষ সে সংকীর্ণ বা সংক্ষিপ্ত বিশেষনে আবদ্ধ নয়।
মানুষের প্রয়োজন বহুবিদ, চেতনা সুগভীর, চিন্তায় থাকে সম্পূর্ণ উদার উদাস করা স্বাধীনচেতা দ্বিতীয় আরেকজন, সে অনেক কিছু চায়। (অবশ্য, ‘অনেকপ্রাপ্তি’র নেশা অনেক সময় স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীনসত্ত্বার পরিপূরক নয়)। ভাবে থাকে ভাষা, চাওয়ার থাকে অর্থময় ব্যঞ্জনা, বলছিলাম, মানুষের স্বাধীনসত্ত্বা, স্বাধীন চেতনা, স্বাধীন জীবন যাপন পশু- পাখি ও কীট পতঙ্গ থেকে বহুগুণে বেশী ও ব্যাপক।
দ্বিতীয়ত: স্বাধীনতা শুধু অর্থের নয়, আত্মার জন্যও চাই। অর্থের প্রশান্তি স্বর্গে নেয় না- আত্মার প্রশান্তি নেয়। আত্মার প্রশান্তি আসে সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পূর্ণ পূত বায়ু-বাতাস অর্থাৎ সঠিক মানবিকতার প্রয়োগ বা চাষাবাদ থেকে। সমাজ বা সভ্যতা অসুস্থ হলে মন মনন আত্মা সুস্থ হয় না। বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধ-বিগ্রহ জনপদের দিকে তাকালে উল্লেখিত কথাগুলির সত্যতার প্রমাণ মেলে।
লন্ডনে আমি চ্যারিটির পক্ষে এক রিফিউজি ক্যাম্পে কিছু দিন কাজ করেছি। আমি অনুসন্ধান করে অনুমান করতে পেরেছি যে, ইরাক ও প্যালেস্টাইনের এক শ্রেণীর মানুষ এখন তত সামাজিক নয়। মনে হয় লাশ আর রক্ত দেখতে দেখতে তারা আর নান্দনিকতার মানে খুঁজতে যায় না। একই কারণে, আফ্রিকার কতক মানুষের মন ও মগজ এতই দুর্বিসহ হয়ে আছে যে, কয়েক শত বছরের আমেরিকা দ্বারা দাসত্বের নির্মম বেদনা আজো যেন ভুলতে পারছে না তারা। তারা জানে তারা দাস ছিল-স্বাধীন ছিল না। সে অপমান, সে কষ্টের বোঝা এখনো তারা যেন বয়ে বেড়ায়, রাস্তায় রাস্তায় মানুষকে কয়ে বেড়ায়।
বলাবাহুল্য, ইংল্যান্ডের জনপদে এখনো কতক কালোদের দেখা যায়, যারা নিজে নিজে কথা বলছে, কাউকে কখনো উচ্চ গলায় কখনো নীচু কন্ঠে গালি দিচ্ছে অথবা অর্থহীন লক্ষ্যহীন রাগ করছে।
আজ সারা দুনিয়ায় অধিন মানুষের হাহাকার। আমরা যারা ইউরোপে আছি আমরা আরো বেশী করে যেন বুঝি স্বাধীনতার অর্থ, স্বাধীনতার মান ও মর্যাদা। কারণ, অস্বাধীন বা স্বাধীনতা হারা, স্বদেশ হারা মানুষের চোখের জল আমাদের বার বার বলে দেয় একটি স্বাধীন দেশ, সে দেশের পতাকা সে দেশের মানুষ কতনই না গর্বিত, সম্মানিত ও হরষিত।
আমি বাংলাদেশের নাগরিক। আমি ধন্য এক মানুষ আমার একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ আছে, আমার একটি পতাকা আছে। যে পতাকাকে খুঁজে বেড়াই ইউরোপের পথে প্রান্তরে, টিভির পর্দায়, খেলার মাঠে, শপিং সেন্টারের মালামালে, পোশাকের লগোতে।
আমি স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ যিনি আমাকে পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর একটি দেশের নাগরিক করে পাঠিয়েছেন।
যাঁরা আমার দেশকে স্বাধীন করেছেন, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন তাঁদের জন্য রইল অনন্ত শ্রদ্ধা।
আমার রচিত একটি কবিতার দুটি লাইন দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই:
“স্বাধীন মানে একটি দেশের
বিশ্ব সভায় আসন”।
(কবিতার নাম: স্বাধীনতার মানে।
বই: স্বাধীনতা আগুন ফাগুন একুশ বিষ।
প্রকাশকাল: ২০১১)
**
২৫.০৩.১৭
লন্ডন।