মাটির জন্য কলম ধর
মাটির নামটি স্বর,
মাটির জন্য মরোরে মন মাটির জন্য মরো।
মাটির জন্য লিখো।
খাঁটির জন্য লিখো।
হে বিশ্বের কলমী বন্ধু!
তোমার বুকে হাত দিয়ে দেখো, কত মহাসাগরের শব্দকল্লোল। ভাববিপ্লব।
তারা বেরিয়ে আসতে চায়। বেরিয়ে আসতে দাও।
অনেক বড়, অনেক ভাব গম্ভীর কবিতা, গান, ছড়া বা প্রবন্ধ লেখার সময় তুমি অনেক পাবে। এখন আমাদের সমস্যা সম্প্রদায়ের ভুল ব্যাখ্যায়। আমাদের সমস্যা সমাজতত্ত্বের ডারউইনী চেতনায়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ মহান ভাবুক। তারা লেখক। তারা সাধক। তারা কবি। পৃথিবীর সবাই কবি। কুকুর শুকরও কবি। গাছপালা লতাপাতাও কবি।
মানুষ হিসেবে তুমি বড় কবি। তাই তুমি পৃথিবীর দুঃখ কষ্টের বড় অংশিদার।
একটি শব্দে বা একটি লাইন লিখে বল তুমি সুন্দরের সাধক, তুমি মানুষকে সম্মান করতে জান, তুমি সমাজের সদস্য, তোমার একটি দেশ আছে, একটি পতাকা আছে, একটি জাতীয় সঙ্গীত আছে। সঙ্গীত পরিবেশনের সময় তোমার বুকে স্পন্দন জাগে। এই কথাটিই প্রকাশ হোক তোমার লেখায়- মানুষের কল্যাণে।
তুমি জান না মনে হয়, দেশের মানুষ গানে- কবিতায় এখন ভাত খুঁজে- ভাব নয়। পাত খুঁজে, জাত নয়।
হে শাসক! গণতন্ত্র ফ্যাক্টর পরের শিক্ষা দিও, আগে আমাদের পেটতন্ত্রের অধিকার চাই।
তন্ত্র-মন্ত্রে কী লাভ আমার/ ভাত দে আগে পেট ভরিয়া/ বহু তন্ত্রের অত্যাচারে/
মানবতা যায় মরিয়া।
হে মানুষ! পৃথিবী এখন দুই শক্তিতে বিভক্ত -পরাশক্তি ও মরাশক্তি। পরাশক্তির দল ভারী নয়। তারা অত্যাচারী। নিউক্লিয়ার হাতে নিয়েও তারা ভীরু। কারণ তারা অসত্যে অসৎ। মরাশক্তিই পরমশক্তি হবে তোমার কলমের কোমল পরম আঘাতে আঘাতে। শুধু তুমি মাটির দিকে তাকাও, দেখবে সহস্র ‘কলমসর্প’ শাপলা হয়ে আকাশের দিকে উত্থিত। একে বিষয় কর। জীবন বিস্ময় করো। বিশ্ব জাগাও। কলম ধরো।
লিখ। কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য লিখ। তোমার মননশীলতার দায়িত্ব পালন কর। অস্তিত্বের ঘোষণা দাও। ব্যক্তিত্বের ফায়সালা হবে আজ। এই তো মনুষ্যত্বের জমিন। আমরা এখানে ‘মানবায়ন’ করব। পৃথিবীতে মানুষের চাষ হবে। পৃথিবীর সবাই মানুষ হবে। মানুষের জন্য সৃষ্ট এই সমাজে সৃষ্টির এক ইঞ্চিও আর অনাবাদি থাকবে না,- সর্বত্র ‘মানববৃক্ষ’ রোপন করা হবে।
মানবায়ন হবে আকাশে গ্রহে নক্ষত্রে পাতালেও।
মনের ফুল নিয়ে অনেক কবিতা হয়েছে, এবার বনের ফুল নিয়ে কবিতা চাই। বনের হিংস্র প্রাণীকে কবিতা শোনাবো। তারা কবিতা শিখুক। তখন অত্যাচারীর বাড়িতে ঘাড়ে বাঘেরাই কবিতার মর্মবাণী পৌঁছাবে।
তোমার শব্দফুল সাধনার নয়, নয় দেব-বলীর জন্য, এ ফুল হবে সহজ প্রাপ্য- সবার জন্য, পথের উলঙ্গ শিশুটির জন্য। শিশুটি চাওয়া মাত্র ফুলটি হাতে তুলে নেবে, কোন রকমের পুলিশ শালিস ছাড়া।
আমি একটি মাটির কলমের কথা বলছি। অনেক অনেক কালির বিনিময়ে একটি পবিত্র হাসির কথা বলছি সম্ভবত।
আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাব-গম্ভীর লেখায় অনেক সময় ভেলায় ভেসে গেছে! এই ভেলাতে ভেসে বেড়ায় আমাদের পেটের হাহাকার!
ও কীসের কবিতা? কার জন্য তপস্যা প্রিয়তম? ওই আকাশির কথা বাদ দিয়ে মাটিতে ফিরে আসো।
জান, জগতে ব্যক্তিগত কোন সাধনা নেই। আরাধনা আছে। আরাধনা একান্ত হওয়া যৌক্তিক। তার প্রয়োজনও আছে। সাধনা সার্বজনীন। যে সাধনায় সর্বসাধারণ নেই, সমাজ নেই, মানুষ নেই, সে সাধনা প্রতারণা। আরাধনা অনেকটা ব্যক্তিগত হলেও সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন।
আমাদের অলি বা হিন্দুদের অনেক সাধু-সন্যাস ব্যক্তি এবং বস্তু পূজারী নন। তাঁরা বিশ্ব সৃষ্টির জন্য, অন্য কথায় মানুষের দুঃখ লাগবে আত্মত্যাগ করে তুষ্টি লাভ করেছেন। সাকার বা নিরাকার যাই বলি না কেন, তাঁরা ইবাদত, পূজো বা প্রার্থনা করে করে পূজিত হয়েছেন।
তুমি আমি তো ধূলিবৎ!
মনে রেখ, অসুস্থ এ বিশ্ব তোমার ব্যক্তিত্বের পরীক্ষা নিচ্ছে, বার বার তোমাকে ধাক্কা দিয়ে জানান দিচ্ছে, ওঠো, জাগো, তন্দ্রামুক্ত রও। উত্তীর্ণ হও ।
সৃষ্টির বিচারে কলমের অধিকার আছে- নিত্য হিত্য সাহিত্য।
তোমার কলম বৈশ্বিক হবে।
হে তরুণ!
জীবনে অনেক অনেক লিখেছ, এবার গৃহ হারা এতিম ঐ ছেলেটির জন্য লিখ।
কালি, কলম, জ্ঞান, গান, প্রাণ, প্রজ্ঞা, চিন্তা ও চেতনা সৃষ্টি সাধনায় আত্মশুদ্ধিতে বিলিয়ে দাও। তোমার আমার স্রষ্টা ওখানে জেগে আছেন। তাই আয়াতুল কুরসিতে আছে, স্রষ্টা ঘুমান না। তাঁর তন্দ্রাও আসে না।
আমাদের এশিয়া মহাদেশে প্রচলিত ওয়াজিফায় দরুদের নামে কিছু কথা আছে। সেখানে বলা হয়েছে –
“ওয়াল বাহরু,ওয়াশ সাজারু লা ইনাম,
কুম কুম ইয়া হাবিবী,
কাম তানাম”?-
সাগর বৃক্ষ ঘুমায় না,
জেগে উঠ, জেগে উঠ হে বন্ধু,
আর কত ঘুমাবে?
এখানে রাত জাগার কথা বলা হচ্ছে না। ব্যক্তিসত্তা, মননশীলতা বা চিন্তা চেতনা যাদের মরে আছে তাদের কথা বলা হচ্ছে। স্রষ্টা নিচের আসমানে ‘আমি’ হয়ে আসেন। আর তুমি
তোমার ‘তুমি’
হারিয়ে অপেক্ষা কর নরকের নোংরা খেতে।
শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতে আছে :
“কিবা, অনুপমভাতি, মোহনমুরতি ভক্ত-হৃদয়-রঞ্জন।
নবরাগে রঞ্জিত
কোটি শশী বিনিন্দিত;
কিবা বিজলী চমকে সে রূপ আলোকে, পুলকে, শিহরে জীবন।”
(শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত
শ্রীম-কথিত।
পৃষ্ঠা:৩৫
অখন্ড সংস্করণ।
প্রথম প্রকাশিত:19983)
খুশির কথা এই বিশাল বইটি আমার সংগ্রহে আছে।
**
নজরুল ইসলাম হাবিবী
লন্ডন।
05. 10.’18